রবিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

প্রিয় মুখটাও যখন অচেনা

...ড্রাইভার-ড্রাইভার গাড়ি থামাও,লাশের জন্য সাদা কাপড় কিনতে হবে। রাস্তার পাশে গাড়ী থামালাম,গাড়ীতে কান্নার আহাজারি,৪ জন লোক কে নিয়ে রওনা হয়েছি যশোরের দিকে,১ জন লাশের বউ,লাশের কখনও বউ থাকতে নেই,৪ জনের এক জন হচ্ছে মৃত মানুষ টির বউ অন্যরা তাঁর ছেলে-মেয়ে,একজন জানতে চাইলো আমার নাম কি? বলাম -মতি।
বলেন 'মতি! তুমি লাশের কাপড় টি পড়িয়ে দাও।"
আমি এক কথায় বলে দিলাম, -পারবো না।"
লাশে গাড়ী চালায় সত্য,তবে আমি এক মাত্র প্রিয় মানুষের লাশের মুখ দেখি, এই ছাড়া আর কোন মৃত- লাশে মুখ দেখি না,আমার বড় বেশি ভয় করে লাশের মুখ দেখলে।
রাত হলে ঘুম হয় না,আমি লাশ দেখলে ভয় পাই,তারপরও চাকরি নিয়েছি পরিবহনে তাইতো লাশের গাড়ী চালায়।
লাশ টি সাদা কাপড়ে মোড়ানো হয়েছে,আমি আবার গাড়ী চালাতে লাগলাম। . যশোরে এর আগে কখনও আমার যাওয়া হয়নি।
কাঞ্জন-দা বলেছিল আমায় সময় করে নিয়ে যাবে,কাঞ্জন-দা'র বাড়ি যশোর ঝিকরগাছা,কাঞ্জন-দা আর আমি এক সাথে বাসা ভাড়া করে থাকি,এই-তো সে দিন কাঞ্জন-দা বুকে ব্যথা উঠেছিল বলে, আমি নিজে হাসপাতারে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এসেছিলাম কাঞ্জন-দা কে।
আজ অবশ্য ভেবেছিলাম তাকে দেখতে যাবো,কিন্তু না তা আর হলো না।
গাড়ী ভাড়া পেয়ে রওনা হলাম যশোরের দিকে।
ইস কঞ্জন-দা থাকলে ভালো হতো,তাকে নিয়ে যেতাম ভাড়া শেষে কঞ্জন-দা বাড়িতে প্রয়োজনে ২ দিন বেড়াতাম।
কাঞ্জন-দা আমায় প্রায় বলতো, -আচ্ছা! মতি,যদি আমি মারা যায়,তুই কিআমার লাশ দেখবি?" আর আমি তখন বলতাম, "কি যে বলো কাঞ্জন-দা, তোমার লাশ দেখবো কি?
নিজের গাড়ীতে করে তোমায় শসানে পোড়াবো।"
কাঞ্জন-দা আমার মুখে এমন কথা শুনে প্রায় বলতেন ভগবান সবার মঙ্গল করুন। . ফেরি ঘাট পার হচ্ছে লাশের গাড়ি,আমার খুব ঘুম পচ্ছে তাই এক কাপ চা খেয়ে নিলাম।
পদ্মার ইলিশ দিয়ে ভাত খেতে ভুল করিনি।
গাড়িতে সবাই কেঁদে যাচ্ছে।
ওদের কান্না দেখে আমার একটুও খারাপ্ লাগছে না।
কত লাশ এই গাড়িতে উঠিয়েছি,প্রথম-্র প্রথম মায়া লাগতো,মানুষের কান্না দেখে। এখন আর কষ্ট লাগে না।
চার-দিক থেকে ফোন আসছে,সবাই জানতে চাচ্ছে লাশের গাড়ী বাড়ি পৌছাতে আর কত সময় লাগবে?
শ্মসান ঘাটে সব আয়োজন করা হয়েছে,আমি অবাক হই এক জন মানুষ নিশ্বাস ত্যাগ করার পর তাকে সবাই লাশ বলে ডাকে।
এই যেনো এক অলিখিত সংবিদ্ধান।
লাশের গাড়ী ঝিকারগাছা এসে পৌছিয়েছে,আমি গাড়ি হতে লাশ টি নামিয়ে দিলাম।
লাশ টি শ্মসান নিয়ে গেছে, চন্দন-গাছের কাঠ দিয়ে লাশ টি কে সাজানো হচ্ছে।
আমি হাত-মুখ ধুতে পুকুর ঘাটে দিকে যাচ্ছিলাম,পুকুরের ওপাড়ে কিছু মুসলিম মানুষ দাড়িয়ে রয়েছে,মনে হচ্ছে তাঁরা মৃত্য মানুষ টি প্রিয় জন।
তাঁরা মুসলিম বলে শ্মসান প্রবেশ করছে না।কেউ এক জন আমায় নাম ধরে ডাকছে পুকুরের ওপাড় হতে। - মতি! মতি। আমি এগিয়ে গেলাম মানুষের ভিড়ে,আমি কি স্বপ্নে দেখছি রিয়াদ- আরিফ আর টিপু ভাই কে,তাঁরা আমার পাশের ফ্লাটে থাকে ঢাকায়,আরিফ আমায় জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো। -মতি! আমাদের কাঞ্জন-দা না ফেরার দেশে চলে গেছে।"
আমি এই কথা শোনা মাত্র শসানের দিকে দৌড়াতে লাগলাম,তবে কি কাল রাতে আমি যে লাশ টি নিয়ে এসেছিলাম,সে আমার কাঞ্জন- দা !!!
আমার চোখে অশ্রু গড়াতে লাগলো,তবে কেন গাড়ীতে থাকা লোক গুলো একটি বারও কাঞ্জন-দা নাম ধরে ডাকলো না? কেন সবাই বার-বার লাশ বলে ডাকলো? আমি শ্মসান ঘাটে এসে প্রবেশ করতে চোখে পড়লো চন্দন গাছের কাঠ দাউ-দাউ করে আগুন জ্বলছে,লাশের সমাধি প্রায় শেষ, আমি চুপ টি করে বসে পড়লাম,আর বলতে লাগলাম, -কথা দিয়ে সব কথা রাখা যায় না,আমি তাঁর লাশ নিয়ে এসেছি শ্মসান ঘাটে, আমি তাঁর মুখ টি খানা দেখিতে পারিনি।"

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন